আশুলিয়া প্রতিনিধি : আশুলিয়ার একই পরিবারের তিনজন খুন হওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার সাগর একজন ‘সিরিয়াল কিলার’। টাকার জন্য নিহত বাবুলের বাসায় কবিরাজ সেজে ঢুকলেও আশানুরূপ অর্থ না পাওয়ায় তিনজনকে হত্যা করেন তিনি। কথিত কবিরাজ হিসেবে পরিচিত সাগরের স্ত্রীর নাম ঈশিতা বেগম। ২ অক্টোবর সোমবার দিবাগত রাতে গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে সাগর ও তার স্ত্রীকে র্যাব-৪ এর একটি দল গ্রেপ্তার করে। ৩ বছর আগে ২০০ টাকার জন্য টাঙ্গাইলের মধুপুরে একই পরিবারের চারজনকে হত্যা করেন এই সাগর। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাগর র্যাব-১২ কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে সাড়ে তিন বছর কারাভোগের পর এক রাজনৈতিক নেতা তাকে ব্যবহারের জন্য জামিনের ব্যবস্থা করেন। ২০২৩ সালের জুন মাসে জামিন পেয়ে গাজীপুরের মৌচাক এলাকায় তার শ্বশুরের ভাড়া বাসায় কিছুদিন অবস্থান করেন। ৩ অক্টোবর মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
র্যাব জানায়, ৩০ সেপ্টেম্বর শনিবার রাত ১০টায় আশুলিয়ার উত্তর গাজীরচট ফকিরবাড়ি মোড় এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে পোশাক শ্রমিক মোক্তারুল হোসেন ওরফে বাবুল, তার স্ত্রী সাহিদা বেগম ও ১২ বছরের ছেলে মেহেদীর রক্তাক্ত ও অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের তিনজনকেই গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর সাগর ও তার স্ত্রী ঈশিতাকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব জানিয়েছে, শারীরিক দুর্বলতার কথা জেনে সাগর কবিরাজ সেজে ওই বাসাতে ঢুকেছিলেন। মূলত অর্থলোভের কারণেই বাসায় প্রবেশ করেন সাগর। প্রথমে অজ্ঞান করলেও পরে কাঙ্খিত টাকা না পেয়েই তিনজনকেই খুন করেন। গ্র্রেপ্তারকৃত সাগর একজন ‘সিরিয়াল কিলার’ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন জানান, ২০২০ সালে মাত্র ২০০ টাকার জন্য একই পরিবারের চারজনকে খুন করেন এই সাগর। জুন মাসে জামিনে বের হন তিনি। সাগরের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, কারাগারে থাকা অবস্থায় প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় সাগরের। সেই ব্যক্তিই তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুন করার জন্য সাগরকে জামিনে বের করেন।
স্থানীয়রা জানান, শনিবার সন্ধ্যায় ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ আসায় আশপাশের বাসিন্দাদের সন্দেহ হলে তারা দরজায় ঠেলা দিয়ে দেখতে পান ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। পরে ঘরের বিছানার ওপর মা ও ছেলের রক্তমাখা মরদেহ দেখতে পান তারা। পরে বাড়ির মালিক পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ ওই ফ্ল্যাটের আরেক রুমে স্বামীর মরদেহ খুঁজে পায়।
র্যাব বলছে, ভুক্তভোগী গৃহকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের শারীরিক চিকিৎসা করতে ৯০ হাজার টাকার চুক্তি করে কথিত কবিরাজ সাগর আলী। বাসায় গিয়ে ইসবগুলের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে একে একে তিনজনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। র্যাব মুখপাত্র মঈন বলেন, নিহত মোক্তার হোসেন ও তার স্ত্রী সাহিদা বেগম আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তার সন্তান মেহেদী হাসান জয় স্থানীয় একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। র্যাব মুখপাত্র বলেন, গত ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারকৃত সাগর সাভার বারইপাড়া এলাকার একটা চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় মোক্তারের পাশের একটি কবিরাজি ও ভেষজ ওষুধের দোকানে তার শারীরিক সমস্যার বিষয়ে চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে দেখেন। গ্রেপ্তারকৃত সাগর জানতে পারেন, মোক্তার ওই দোকানে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসা বাবদ ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ করেও কোনো ফলাফল পাননি। সাগর কৌশলে মোক্তারকে ডেকে নিয়ে আলাপচারিতায় ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার প্রতি তার আগ্রহ ও আস্থার কথা জানতে পারেন। মোক্তার তার ও তার পরিবারের বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার কথাও সাগরকে জানান। সাগর জানায়, তার স্ত্রী একজন ভালো কবিরাজ এবং সে তার সমস্যার সমাধান করে দেবে। এমন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কথাবার্তার এক পর্যায়ে ৯০ হাজার টাকার চুক্তি করেন। সাগর ও তার স্ত্রী পরদিন ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে ওষুধসহ তার বাসায় গিয়ে চিকিৎসা করবে বলে জানান। যোগাযোগের জন্য মোক্তারকে সাগর নিজের নম্বর না দিয়ে এক আত্মীয়ের মোবাইল নম্বর দেন। বাসায় গিয়ে সাগর স্ত্রী ঈশিতাকে পুরো ঘটনা ও পরিকল্পনার কথা জানান। বিপুল অঙ্কের অর্থ পাওয়ার আশায় রাজি হন সাগরের স্ত্রী। তারা পরিকল্পনা করেন ভুক্তভোগী মোক্তারের বাসায় গিয়ে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার কথা বলে তার পরিবারের সবাইকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাদের অর্থসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাগর গাজীপুরের মৌচাক এলাকার একটি ফার্মেসি থেকে এক বক্স ঘুমের ওষুধ ক্রয় করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে গ্রেপ্তারকৃত সাগর ও তার স্ত্রী গাজীপুরের মৌচাক থেকে মোক্তারের সঙ্গে জামগড়া মোড়ে সাক্ষাৎ শেষে বাসায় যান। সেখানে প্রাথমিক পরিচয়ের পর গ্রেপ্তারকৃত সাগরের স্ত্রী ঈশিতা তাদের সমস্যার কথা শুনেন এবং ইসবগুলের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে তাদের ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার ওষুধ বলে খাওয়ান। মোক্তার, তার স্ত্রী ও ছেলে ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়লে সাগর ও তার স্ত্রী মিলে প্রথমে মোক্তারের কক্ষে গিয়ে মোক্তারের হাত ও পা বাঁধেন, পরে মোক্তারের স্ত্রীর হাত-পা বাঁধেন। পরে তারা মোক্তারের মানিব্যাগ, তার স্ত্রীর পার্স ও বাসার অন্য স্থানে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রীর জন্য তল্লাশি করে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বঁটি দিয়ে প্রথমে মোক্তারের গলায় উপর্যুপরি কোপ দিয়ে হত্যা করেন সাগর। পরে অন্য কক্ষে গিয়ে ছেলে ও স্ত্রীকে একই বঁটি দিয়ে পর্যায়ক্রমে কুপিয়ে হত্যা করেন। পালানোর আগে তারা মোক্তারের হাতে থাকা আংটি খুলে নিয়ে যান। গ্রেপ্তারকৃত দম্পতি ভিন্ন পথে রিকশাযোগে গাজীপুরের মৌচাকে তার শ্বশুরবাড়ি যায় এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারের পর তারা আত্মগোপনে চলে যান। পরে আত্মগোপনে থাকাকালেই গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে তারা সোমবার রাতে গ্রেপ্তার হন। আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জোহাব আলী বলেন, ঘটনার পর স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে বিছানার ওপর মা ও ছেলে দুজনের লাশ দেখতে পাই। পরে পাশের ঘর থেকে আরেকজনের লাশ পেয়েছি। মনে হয় এটি স্বামীর লাশ। ঘরে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছিল। আনুমানিক ৩ দিন আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
Leave a Reply