সংবাদ রিপোর্ট : সাধনা-বিকাশ দম্পতির সংসারে এখন শুধুই আধার। সাভারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলিতে নিভে গেছে তার ছোট ছেলে শুভ শীলের (২৪) প্রাণপ্রদীপ। অভাবের সংসারে দু:খ ঘুচাতে মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে তৈরী পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন শুভ। আন্দোলন চলাকালে মামার বাসায় বেরিয়ে জিরানীর বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়ে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে গত ২০ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩ জুলাই ভোর ৫টা ৪ মিনিটের দিকে শুভর মৃত্যু হয়। আদরের দুলাল শুভর মৃত্যুর পর তার বাবা বিকাশ শীল, মা সাধনা রানী শীল, ও বড়ভাই সোহাগ শীলের শরীর যেন অবশ হয়ে পড়েছে, কাজকর্মে মন বসে না। সারাক্ষণ শুভর স্মৃতি তাড়া করছে তাদের। বিশেষ করে মৃত্যুর আগে মা ও বড়ভাইয়ের কাছে তার আকুতি এখনো কানে ভাসছে তাদের। শুভ শীল মা ও ভাইয়ের সঙ্গে আশুলিয়ার চক্রবর্তী এলাকার কে এ সি ফ্যাশন লিমিটেডে কাজ করতেন। ছিলেন সুইং অপারেটর। তিনি ঝিনাইদহ জেলার সদর থানার ঘোরশাল ইউপির মনোরিয়া গ্রামের বিকাশ শীলের ছেলে। পরিবারের সঙ্গে আশুলিয়ার জিরানি বাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। পরিবারের দুই ভাইয়ের মধ্যে শুভ ছিলেন ছোট। আগে থাকতেন সাভার পৌর এলাকার দক্ষিণপাড়া মহল্লায়। তার বাবা পেশায় নরসুন্দর।
শুভর মা সাধনা শীল কাঁদতে কাঁদতে এখন অনেকটা নির্বাক। তিনি বলেন, শুভ গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বেলা ১২টার পর জিরানির বাসা থেকে ধামরাই চৌঠাইল এলাকায় মামা বাসুদেব বিশ্বাসের বাসার উদ্দেশে বের হয় শুভ। শুক্রবার রাতে মামার বাসাতেই ছিলেন শুভ। পরদিন ২০ জুলাই শনিবার বিকাল ৪টার দিকে মামার বাসা থেকে বের হয়ে জিরানির নিজের বাসার উদ্দেশে রওনা হয় সে। পথিমধ্যে সাভার বাসস্ট্যান্ডে নিউ মার্কেটের সামনে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে আটকা পড়ে শুভ। এ সময় গোলাগুলির মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে পাশে মার্কেটে আশ্রয় নেয় সে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বাইরে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে শুভ। এ সময়ই গুলিবিদ্ধ হয় সে। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থাতেই শুভ তার মায়ের নম্বরে ফোন করে নিজের অবস্থার কথা জানায়। পরে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তার পড়ে থাকার পর আশপাশের লোকজন সন্ধ্যায় তাকে উদ্ধার করে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সাধনা জানান, ওইদিন কারফিউর কারণে পথে যানবাহন না থাকায় অনেক কষ্টে রাত ৮টার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান তারা। তিনি বলেন,-গিয়ে দেখি আমার বাচ্চাটা বেডে পড়ে কাতরাচ্ছে। কাইন্দা কাইন্দা কয়, মা, আমি আর বাঁচব না। হাসপাতালের বেডে শুয়ে একটু জল চাইছিল বাচ্চাটা আমার কাছে। বলছিল, মা, আমাকে একটু জল দাও। খুব কষ্ট হচ্ছে, মা, আমার। শরীর অবশ হয়ে আসছে, আমি মনে হয় আর বাঁচব না, মা। শেষবার একটু জল দাও, মা।’ আমি আমার বাচ্চাটার মুখে শেষবার এক ফোঁটা জলও দিতে পারিনি, ডাক্তারদের অনেক অনুরোধ করেছি। ডাক্তাররা বলছিলেন জল দেয়া যাবে না। সাধনা জানান, হাসপাতালে যাওয়ার পর ছেলের জন্য রক্ত জোগাড় করি অনেক কষ্টে, কারণ কেউ সে সময় এই পরিস্থিতির মধ্যে বের হতে পারছিল না। একদিকে রক্ত দেয়, আরেকদিক দিয়ে বের হয়ে যায়। সেদিন রাতে শুভকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পর সেখান থেকে আইসিইউতে নেয়া হয়। অপারেশনের পর আর কথা বলেনি শুভ। ২৩ জুলাই ভোর ৫টা ৪ মিনিটে মারা যান শুভ। তিনি তার ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেছেন। সাধনা শীল বলেন, ঝিনাইদহে একটু ভিটামাটি ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই তাদের। আশুলিয়ার জিরানি মান্নান কলেজের পাশে টেঙ্গুরি এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। দুই ছেলে ও নিজে গার্মেন্টসে চাকরি করেন সবার আয়ে টাকা জমিয়ে বাড়িতে একটা ঘর করার আশায়। শুভর এমন মৃত্যু সব আশা কেড়ে নিয়েছে। পুরো সংসারটা এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন খোঁজ নেয় না কেউ।
শুভর বড়ভাই সোহাগ শীল জানান, করোনাকালীন সময়ে এসএসসি পাশ করার পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে মা ও তার (বড়ভাই) সঙ্গে শুভ নিজেও বছরখানেক আগে পোশাক কারখানায় যোগ দেন। ঘটনার আগের দিন ধামরাই চৌটাইল প্রাইমারী স্কুলের পাশে মামার বাসায় বেড়াতে যাওয়াই শুভর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সোহাগ বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে শুভ মায়ের মোবাইল ফোনে কল করলে সোহাগ সেটি রিসিভ করেন। গলা শুনে শুভ তাকে বলেন, ‘দাদা, আমি তো শেষ। আমাকে গুলি করছে, দাদা। অনেক কাকুতি-মিনতি করছি, আমার কোনো কথা শোনেনি। বলছি আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি, তা-ও আমার কলার ধরে রাস্তায় টেনে এনে পেটে বন্দুক ঠেকায়ে গুলি করছে দাদা।’ সোহাগ জানান, শুভর মৃত্যুর ঘটনায় অনেকেই তাদেরকে মামলা করতে বিভিন্নজনের নাম বলে পরামর্শ দেন। ১২৬ জনের নামের একটি তালিকাও দেয়া হয়। কিন্তু তারা মামলা করেননি। অবশ্য তাদের অভাবের সংসারে সাহায্যের হাত বাড়ায়নি কেউই। সরকারিভাবে মিলেনি কোনো সহায়তা। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকেও ডাক পড়েনি পরিবারের কারো।
Leave a Reply