আশুলিয়া প্রতিনিধি : আশুলিয়ায় উচ্ছৃঙ্খল এবং বখাটে এক শিক্ষার্থীর মারধরে আহত শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার মারা গেছে। ২৭ জুন সোমবার সকালে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবির পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। এনাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ইনচার্জ ইউসুফ আলী তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত শনিবার দুপুরে নিহত শিক্ষকের কর্মস্থল আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী কলেজে প্রকাশ্যে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাপ্প দিয়ে বেধরক পিটিয়ে ও খুচিয়ে গুরুতর আহত করে ওই প্রতিষ্ঠানেরই দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতু। এঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহত উৎপল কুমার সরকার (৩৫) সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার এলংজানি গ্রামের মৃত অজিত সরকারের ছেলে। সে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজের কলেজ শাখার রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এবং আভ্যন্তরিন শৃংখলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। গত দশ বছর ধকে উৎপল কুমার সরকার ওই প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে আসছেন। অন্যদিকে মারধরের অভিযোগ উঠা শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতু (১৬) আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার উজ্জ্বল হাজীর ছেলে। সে হাজী ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেনীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষকরা জানান, প্রতি বছরের মতো এবারো হাজী ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। ২৫ জুন শনিবার দুপুরে খেলা চলাকালীন সময়ে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে উৎপল সরকারকে বেধরক পিটাতে থাকে। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষকের মাথায় আঘাত করে এবং স্ট্যাম্পের সুচালো অংশ দিয়ে পেটের বিভিন্ন অংশে আঘাত করেন। পরে শিক্ষকরা এগিয়ে গেলে ওই ছাত্র সেখান থেকে সটকে পরেন। গুরুত্বর আহত অবস্থায় উৎপল সরকারকে প্রথমে আশুলিয়া নারী ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেয়া হয়। কিন্তু আঘাত গুরুতর হওয়ায় তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ জুন সোমবার সকালে তিনি মারা যান। এদিকে বখাটে শিক্ষার্থী জিতুর মারধরে আহত শিক্ষক উৎপল সরকারের মৃত্যুর খবর বিদ্যায়য়ে ছড়িয়ে পড়লে শোকে ভেঙ্গে পড়েন প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরক শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা। পড়ে তাৎক্ষনিকভাবে হত্যাকারী জিতুকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের সামনেই মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছেন তারা। আয়োজিত মানববন্ধন থেকে শিক্ষার্থীরা জানায়, জিতু একজন বখাটে ছেলে। সে প্রায় উঠতি বয়সী কিশোরদের নিয়ে বিদ্যালয়ের সামনে আড্ডা দিতো এবং অনেক ছাত্রীকে ইভটিজিং করতো। এসব বিষয়ে আমাদের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার প্রতিবাদ করায় তাকে বেধকর পিটিয়ে হত্যা করেছে কিশোরগ্যাং লিডার জিতু। আমরা জিতুসহ তার দলের সকলের বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। হাজী ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজে অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান বলেন, সেদিন দুপুরে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চলাকালে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন শিক্ষক উৎপল সরকার। এসময় দশম শ্রেনির ছাত্র জিতু ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে তাকে মারধর করে। উৎপল সরকার শৃংখলা কমিটির সভাপতি হওয়ায় তিনি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে পদক্ষেপ নিতেন। কেন ওই ছাত্র এমন ঘটনা ঘটিয়েছে সেটি এখনো কেউ সুর্নিষ্টভাবে বলতে পারছেন না। অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান আরও বলেন, এভাবে দিনে-দুপুরে বখানে একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে মেধাবী শিক্ষককে পরিকল্পিতভাবে পিটিয়ে হত্যা করায় আমিসহ ৫৫ জন শিক্ষক ও কর্মচারীরা বর্তমানে আতঙ্কে রয়েছি। এর আগে বিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে আসা পুলিশকে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে শংসয়ের কথা জানিয়েছিলাম কিন্তু তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি। লোকমুখে শুনতে পাচ্ছি হত্যাকারী জিতু উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে আসবে এবং এলাকায় তার বখাটেপনা চালিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষক হত্যাকরী জিতুর একটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। সে তাদেরকে নিয়ে গভীর রাতেও বিদ্যালয়ের গেটে অবস্থান করে। আমরা এই হত্যাকারীর উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে মঙ্গলবার মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কমসূচীর ঘোষনা দিয়েছি। পাশাপাশি এই হত্যাকান্ডের বিষয়টি তদন্তের জন্য বিদ্যালয় থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি ঘোষানা করা হবে বলে জানান তিনি। নিহতের ভাই অসীম কুমার সরকার বলেন, ঘটনার দিন বাসা থেকে স্কুলের পাশেই আমার দোকানে আসার সময় জানতে পারি আমার ছোট ভাইকে শিক্ষার্থী জিতু স্ট্যাম্প দিয়ে পিটাইছে। হাসপাতালে গিয়ে শুনি পেটে, বুকে, পিঠে ও মাথায় স্ট্যাম্প দিয়ে মারধর করছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ জুন সোমবার আমার ভাই মারা গেছে। তিনি বলেন, আমার ভাই শিক্ষার্থীদের নীতি নৈতিকতার বিষয়টি দেখেন। দশম শ্রেনির ছাত্র জিতু বিভিন্ন সময়ে ছাত্রীদের উত্যক্তকরণসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িত। বিভিন্ন সময় ভাই জিতুকে বুঝালেও সে সংশোধন হয়নি। উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে জিতু স্ট্যাম্প দিয়ে পিটাইয়া আমার ভাইরে মাইরা ফালাইছে। আমি প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে এর উপযুক্ত বিচার চাই যাতে আর কোন শিক্ষককে ছাত্রের হাতে মরতে না হয়।মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. এমদাদুল হক বলেন, শিক্ষক উৎপল সরকার ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা রক্ষায় শাসন করতেন। হয়তো পূর্বের এমন কোন বিষয়ে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
তিনি আরও বলেন, মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত জিতুসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামীকে করে নিহতের ভাই অসীম কুমার সরকার মামলা করেছেন। ইতিমধ্যে আসামীকে ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়া নিহতের মরদেহটি হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
Leave a Reply