সংবাদ রিপোর্ট: সাভারের বহুল আলোচিত রানা প্লাজা ধসের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়নি এবং ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও তাদের পরিবার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাননি। জামিনে কারামুক্ত আছেন সোহেল রানা ছাড়া মামলার সব আসামি। নানা জটিলতায় মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হলেও ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কোথাও সদুত্তর পাচ্ছেন না। আজ সেই আলোচিত ঘটনার এক যুগ পূর্তি হলো । ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশ-বিদেশে আলোরিত ওই দুর্ঘটনায় ১,১৩৮ জন শ্রমিক নিহত হন এবং আরো অন্তত ১,৭৬৯ জন আহত হন। যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী ও তরুণ।
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি এডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকীর সঙ্গে বুধবার (২৩ এপ্রিল) বিকেলে যোগাযোগ করা হলে তিনি রানা প্লাজা সংক্রান্ত মামলার সর্বশেষ অবস্থা অবগত নয় বলে জানান। পরে বিস্তারিত জেনে জানাবেন বলে জানান।
আদালত সূত্র মতে, রানা প্লাজা ধসের পর বিবভিন্ন অভিযোগে থানা ও আদালতে মোট ১৫টি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলা, ইমরাত নির্মাণ আইনে একটি, আইন না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে মামলা করে রাজউক, ভবন নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং শ্রম আইনে ১১টি মামলা দায়ের করা হয়। সাক্ষী প্রমান এবং উচ্চ আদালতের স্থিতাদেশের কারণে ঝুলে আছে এসব মামলা। ঘটনার পর প্রথমে তিনটি মামলা হয়। বর্তমানে হত্যা মামলাটি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। মামলাটিতে এ পর্যন্ত ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। তবে ওইদিন সাক্ষী না আসায় আগামী ১৯ মে পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। অন্যদিকে ইমারত আইনের মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে.এম.মহিউদ্দিনের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ৯ এপ্রিল মামলায় উচ্চ আদালতের আদেশ দাখিলের জন্য ছিলো। তবে আসামিপক্ষ তা দাখিল করতে পারেনি। এজন্য আগামি ৩১ আগস্ট আদেশ দাখিলের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। তবে এত দিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে শ্রমিক মৃত্যুর এই মামলাটি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আসামিরা হলেন- সোহেল রানা (ভবন মালিক হিসেবে উল্লেখকৃত), তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক (করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন), মা মর্জিনা বেগম (ক্যান্সার রোগী), সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফাত উল্লাহ, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আমিনুল ইসলাম, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার এবং রেজাউল ইসলাম। সবকটি মামলায় রানা ছাড়া সবাই জামিনে কারামুক্ত আছেন। রানা একাধিকবার জামিন পেলেও সর্বোচ্চ আদালত সেই আদেশ স্থগিত করায় তিনি কারাবন্দি আছেন প্রায় এক যুগ ধরে। আসামিদের আবেদনের কারণে উচ্চ আদালতের আদেশে আটকে আছে অনেক মামলার বিচারকাজ।
অপরদিকে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আইনে দায়ের করা মামলাটিও হাইকোর্টে স্থগিত হয়ে আছে। ফলে, আইনি জটিলতার কারণে এগোচ্ছে না এই মামলার কার্যক্রম। শ্রমিক মৃত্যুর হত্যা মামলাটি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করে আসামিপক্ষ। আবার আইন না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে ওই সময় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৎকালীন (রাজউক) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল আহমেদ। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার সাক্ষী করা হয় ১৩০ জনকে। অভিযোগপত্রের ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে রানা প্লাজা নির্মাণে ছয় তলার অনুমোদন থাকলেও আট তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। এ কারণে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম। মামলাটি বিচারাধীন। এ মামলায় মোট ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছেন আদালত।
অন্যদিকে রানা প্লাজা ধসে হতাহতদের দ্রুত তাদের ক্ষতিপূরণ, বিচার সম্পন্ন ও নিহতদের স্মরণে স্মৃতিফলক করার দাবি জানিয়েছে বেসরকারি আইন সহায়তা সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। মঙ্গলবার ব্লাস্টের দেওয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পূর্বপাশে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় ১,১৩৮ জন শ্রমিক নিহত হন এবং আরো অন্তত ১,৭৬৯ জন আহত হন। যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী ও তরুণ। বিবৃতিতে বলা হয়, রানা প্লাজার ঘটনায় দায়ের হওয়া ১১টি শ্রম (ফৌজদারি) মামলা এখনো ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন। এর মধ্যে চারটি মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর্যায়ে রয়েছে, চারটি মামলার নোটিস পত্রিকায় প্রকাশের অপেক্ষায় এবং বাকি তিনটি মামলার কজলিস্টে তারিখ বা নম্বর হালনাগাদ হয়নি। এছাড়া দায়রা আদালতে তিনটি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে একটি মামলা ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২-এর আওতায় হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে। বাকি দুটি মামলা দণ্ডবিধির আওতায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একত্রে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে ইতিমধ্যে ৯৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য হয়েছে আগামী ১৯ মে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এই ট্র্যাজেডির দায় কেউ নেয়নি, বিচার হয়নি, ক্ষতিপূরণও হয়নি। আমরা চাই, দ্রুত বিচার শেষ হোক, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন হোক, আর এই ঘটনা যেন কোনো দিন ভুলে না যাওয়া একটি শিক্ষা হয়ে থাকে।’ ব্লাস্টের পক্ষ থেকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি, গণমাধ্যমে অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা, আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুসারে ক্ষতিপূরণ, আহতদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, এবং জুরাইন কবরস্থানে নিহতদের নামসহ স্মৃতিফলক নির্মাণ।
Leave a Reply