সংবাদ ডেস্ক: যে পরিবারে সবাই শিক্ষিত, সে পরিবারে এমন একটা দীপ্তি আছে, যা অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দেয়।—রবার্ট ফ্রস্টের এ কথার সঙ্গে মিলে যায় আবুল কালাম আজাদ মিয়ার গল্প। ৬৭ বছর বয়সেও ছেলেদের সহযোগিতায় শুরু করেছেন পড়ালেখা। এবার তিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পার্শ্ববর্তী জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জের একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা অংশ নিয়েছিলেন। তিনি জিপিএ ২.৯৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। নতুন করে পড়ালেখা করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আজাদ মিয়া বলেন, এলাকার অনেকেই প্রথম হাসাহাসি করলেও এখন আর কেউ এমন করে না। আর শিক্ষার কোনো বয়স নেই। মহানবী (সা.) শিক্ষাগ্রহণে সুদূর চীন দেশে যেতে বলেছেন। তাই আমি আমার ইচ্ছাটা শেষ বয়সে হলেও পূরণ করতে চাই। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়াকাজীরচর ইউনিয়নের লংগরপাড়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদ। কবি কালাম হিসেবে তিনি গ্রামে পরিচিত। পরিবারের অনটনের কারণে পড়ালেখা গণ্ডি না পেরুতে পারলেও নিজের তিন ছেলেকে করেছেন উচ্চ শিক্ষিত। বড় ছেলেকে ইংরেজির শিক্ষক, মেজো ছেলেকে কামিল (এমএ) পাশ ও ছোট ছেলেকে বানিয়েছেন প্রকৌশলী। তার এ সাফল্য অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে স্থানীয়দের পড়াশোনা করতে।
জানা যায়, লংগরপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল রশিদ মণ্ডলের ছেলে আবুল কালাম আজাদ। ১৯৭৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি। হাবিবুর রহমান, আবুল কালাম আজাদ, সুলতান মিয়া, ফারুক মন্ডল, জুলফিকার আলী ভুট্টো—এ ৫ ভাইয়ের অভাব অনটনের সংসারের হাল ধরতে পরীক্ষা না দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন কালাম। চাকরি করেন থাকেন ২২ বছর। তারপর করেন বিয়ে। ঢাকায় গিয়ে বাংলামটরে একটি সান্ধ্যকালীন স্কুলে পড়াশোনার চেষ্টা করেন। কিন্তু সময় স্বল্পতায় তা আর হয়ে ওঠেনি কালামের। বিয়ের পর চাকরি নিয়ে সৌদি আরবে যান। সেখানে দীর্ঘ ১৮ বছর প্রবাস জীবন কাটান। এরপর বাড়ি ফেরে মন দেন লেখালেখিতে। লিখেন নানা কবিতা ও ছড়া। এছাড়াও লিখেছেন গান ও উপন্যাস। ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে দুটি কবিতার বইও। আবুল কালাম আজাদ জানান, ছোটবেলা থেকেই তার প্রবল আগ্রহ ছিল পড়ালেখা করার। ১৯৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ এবং পরবর্তীতে তাদের বাড়িতে আগুন লাগে, এতে অভাবে পড়ে তাদের সংসারে। বড় পরিবারের হাল ধরতে চলে আসনে ঢাকায়। নেন চাকরি। এখানে এসেও পড়ালেখা করতে চেয়েছেন। বাংলামটরসহ কয়েকটি জায়গায় সান্ধ্যকালিন স্কুলে খোঁজ নিলেও নানা কারণে তা আর পড়াশোনা হয়ে উঠেনি। পরে ঢাকা থেকে সৌদি আরব চলে যান। ১৮ বছর থাকেন প্রবাসে। সেখান থেকে ফিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সাংসারিক কাজে। আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ২৭টি কবিতা লিখেছি। আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাঁচটি কবিতা লিখেছি। আমার লেখা কবিতাগুলো প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছানোর সুযোগ চাই। দেশের উন্নয়ন নিয়েও আমি কবিতা লিখেছি। এখনও কবিতা লিখি।
পড়ালেখা না করেও কবিতার বই প্রকাশ করে ও শেষ বয়সে পড়ালেখা শুরু করে এলাকায় প্রশংসিত হচ্ছেন আবুল কালাম আজাদ। এ খবরে তারা যেমন খুশি, তেমনি লেখাপড়াতেও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন অনেকে। আবুল কালামের ছোট ভাই ও শেরপুর জজকোর্টের শিক্ষানবিশ আইনজীবী জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, আমাদের অভাব অনটন ঘোচাতে বড় ভাই সেসময় ঢাকায় চাকরির খোঁজে চলে যান। তাই আর পড়াশোনা করতে পারেনি। কিন্তু গান, কবিতা, ছড়া লেখার যে আগ্রহ ছিলো, তা ধরে রেখেছেন। এবং আমাদেরসহ আমার ভাতিজাদের পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন শক্ত অবস্থানে। ভাই এবার পরীক্ষা দিয়েছিলন, পাশ করেছেন। এতে আমরা খুব খুশি। মেজো ছেলে আরিফুল ইসলাম বলেন, বাবা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমাদের তিন ভাইকে পড়ালেখা করিয়ে ভালো চাকরির ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। তার নিজের ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করার। আমরা এখন তার ইচ্ছাপূরণের জন্য কাজ করছি। বাবার যতটুকু পড়তে মন, চায় আমরা পড়াব। আর বাবার পাশের খবর শুনে আমরা খুব খুশি। আশরাফুল আলম নামের এক তরুণ বলেন, আমরা তরুণ বয়সেও পড়ালেখা করতেই চাই না। আর কামাল দাদা বৃদ্ধ বয়সে পড়ালেখা করে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন। তার মাধ্যমে আমরাও পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হবো। রেজাউল করিম নামে আরেকজন বলেন, আমরা তো খুব খুশি আমাদের জ্যাঠা শেষ বয়সে পড়ালেখা করছেন। তার কবিতাও আমরা তার কাছ থেকে শুনি। খুব ভালো লাগে কবিতাগুলো। স্থানীয় ইউপি সদস্য রিয়াজুল ইসলাম ঠান্ডা বলেন, আবুল কালাম আজাদের কবিতার বইগুলো আমি পড়েছি। খুব ভালো লেখনি তার। তিনি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ করেছেন। এটাতে আমরা খুব খুশি। খড়িয়াকাজীরচর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক সবুজ মিয়া বলেন, আবুল কালাম আজাদের জীবন খেয়াল করলে রবার্ট ফ্রস্টের ‘যে পরিবারে সবাই শিক্ষিত, সে পরিবারে এমন একটা দীপ্তি আছে, যা অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দেয়।’ বাণীটি মনে পড়ে। তিনি তার ৩ ছেলেকেই উচ্চ শিক্ষিত করেছেন। ভাইদেরকেও পড়ালেখা করিয়েছেন। এখন জীবনের শেষদিকে এসে নিজেও বসেছিলন এসএসসির পরীক্ষার্থীর আসনে। পাশও করেছেন। এটা খুব আনন্দের ব্যাপার এবং তিনি অনুকরণীয়। খড়িয়াকাজীরচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান দুলাল মিয়া বলেন, গ্রামে তিনি কবি কালাম নামেই পরিচিত। তিনি যে শেষ বয়সে এসে ধৈর্য ধরে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, এতে আমরা খুব খুশি।
Leave a Reply