1. kamruzzaman78@yahoo.com : kamruzzaman Khan : kamruzzaman Khan
  2. ssexpressit@gmail.com : savarsangbad :
শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৭ পূর্বাহ্ন

জীবন হাতের মুঠোয় নিয়েও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংরক্ষণ করেছিলেন সাভারের আমজাদ

  • আপডেট সময় : সোমবার, ৭ মার্চ, ২০২২

সংবাদ রিপোর্ট: স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও যে ভাষণ শুনে বাঙালির বুকে কম্পন সৃষ্টি হয় সেটা হলো রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ। যে ভাষণ শুনে লাখ লাখ বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে দেশের জন্য যুদ্ধ করে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। সেই ভাষণ জীবন বাজি রেখে সংরক্ষণ করেছেন আমজাদ আলী খন্দকার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় ১২ বছর আগে সাভারের মধ্যগেন্ডা এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন তিনি। সাভারে বসবাসের এক বছর পরে তিনি তার স্ত্রী মমতাজ বেগমকে হারান। এরপরই তিনি আক্রান্ত হন প্যারালাইসিসে। তখন থেকে তার ছেলে খন্দকার মাসুদ দেখাশোনা করে আসছেন। বর্তমানে তিনি একা চলাফেরা করতে পারেন না। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করা থেকে শুরু করে সংরক্ষণ পর্যন্ত তিনি গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। তবুও তার খোঁজ রাখেন না কেউ। পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। করা হয়নি সু-চিকিৎসার ব্যবস্থাও। তবে এই নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড ও সংরক্ষণের স্বীকৃতি পেয়ে তিনি অনেক বেশি খুশি। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের সুতালরি ইউনিয়নের মুনসীডাঙ্গী গ্রামের সাফায়েত আলী খন্দকারের ঘরে বাংলা ১৩৫০ সালের ১০ আশ্বিন জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বর্তমানে সাভারের মধ্যগেন্ডা এলাকায় চার সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন। তার অন্য তিন সন্তান ঢাকায় থেকে বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ৬ মার্চ রবিবার বিকেলে সাভারের মধ্যগেন্ডা এলাকায় নিজ বাসভবনে আমজাদ আলী খন্দকার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংরক্ষণের ইতিহাস তুলে ধরেন সাভার সংবাদের কাছে। আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে আমার পরিচালকসহ বেশ কিছু বাঙালি কর্মী ছিলাম। ১৯৬৯ সালের শুরু থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গোপনে ধারণ করে সংরক্ষণ শুরু করি। সবশেষে ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ডের নির্দেশনা দেন আমাদের পরিচালক মহিবুর রহমান খান (অভিনেতা আবুল খায়ের)। আমরা আগেই প্রস্তুতি নিয়ে সব সরঞ্জাম নিয়ে মাঠে চলে যাই। মূলত তার নির্দেশেই আমিসহ আরও কয়েকজন ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিও ধারণ করি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যানবাহন ও হেঁটে সমবেত হয়েছিল মানুষ। লাখ লাখ মানুষের গর্জনে কেঁপে উঠেছিল রেসকোর্স ময়দান। এত মানুষের মধ্যে ভিডিওচিত্র ধারণ করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। এরই মাঝে ভিডিওচিত্র ধারণের কাজ করেন আমজাদসহ চলচ্চিত্র বিভাগের ক্যামেরাম্যান জেড এম এ মবিন, ক্যামেরাম্যান এম এ রউফ, ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার, ক্যামেরা সহকারী এস এম তৌহিদ, ক্যামেরা সহকারী সৈয়দ মইনুল আহসান, ক্যামেরা সহকারী জোনায়েদ আলী ও এমএলএসএস খলিলুর রহমান। তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে ভিডিও ধারণের কাজ করেন। এক দল ভিডিওধারণ করবেন মূল ভাষণ আর আরেক দল করবেন সেখানকার সার্বিক পরিবেশ।

আগের দিন থেকেই ছিল প্রস্তুতি

রাত থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। আমরা ভিডিও ধারণ করব বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে। ব্যাটারি দিয়ে রেকর্ড করলে চার্জ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কারন বঙ্গবন্ধু কী বলবেন, কতক্ষণ ভাষণ দেবেন তা আমাদের জানা ছিল না। তাই আমরা আধা ঘণ্টা কিংবা এক ঘণ্টা বক্তৃতা দেওয়ার মতো ফিল্ম নিয়ে গেছিলাম। স্ক্রু ড্রাইভারসহ যা যা লাগে সবই আমরা নিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পরে গিয়ে আমরা তার (ক্যাবল) লাগাই। কলরেডি ছিল, তাদের বিদ্যুতের বোর্ড ছিল। সেখানে হাইভোল্টেজের তার ছিল। সেখানকার ওয়ার্কার আমাকে লাইন দিচ্ছিল না। কলরেডির মালিক ছিল, তিনি দেখে লাইন দিতে বলেন। আমরা আগে থেকেই খুব এলার্ট ছিলাম।

রেকর্ড করার কৌশল

সেদিন খুবই আওয়াজ ছিল। মাইকের কাছে ঘ্যার ঘ্যার শব্দ ছিল অনেক বেশি। এজন্য ক্যামেরা ঢেকে রেকর্ড করলাম। আমি আর মবিন সাহেব ক্যামেরায় দক্ষ ছিলাম। তাই ভাষণ রেকর্ড করার দায়িত্ব আমাদেরই দেওয়া হয়। লাইটম্যান ছিল দুইজন। তারা আমাদের সহযোগিতা করেন। আর রউফ সাহেব ও তৌহিদ ঘুরে ঘুরে শট নেন। এভাবেই পুরো ভাষণ রেকর্ড করলাম। রেকর্ডের পর বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন। পুরো মাঠ খালি হয়ে গেল। আমাদের গাড়ি এল, সব তুলে নিয়ে অফিসে গেলাম।

সেদিন ছিল জীবন সংশয়   

সেদিন গুজব উঠেছিল বোমা মেরে সবকিছু উড়িয়ে দেওয়া হবে। গুজব থাকা সত্বেও আমরা কিন্তু ভয় পাইনি। মারা গেলে তো গেলামই। আর যদি গ্রেফতার হই তাহলে বঙ্গবন্ধু আমাদের নিশ্চয়ই ছাড়িয়ে নেবেন। ওই দিন প্রকাশ্যে আমরা আটজন পাকিস্তানির বিরোধীতা করি। সেদিন সবাই পাকিস্তানের বিরোধী ছিল। কিন্তু আমরাই প্রথম প্রকাশ্যে পাকিস্তানের বিরোধীতা করি। বঙ্গবন্ধু আর আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কাজ করেছিলাম।

ফিল্ম ডেভেলপ

পরের দিন অফিসে গেলাম। ফিল্ম ডেভেলপ করতে হবে এফডিসিতে। ফাইলে কী লিখব? বিল হবে কার নামে? নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগলাম। সরকারি বিল করতে হবে তো। তখন সাইক্লোন ও নির্বাচন ছিল। শুধু এই দুটিতে বিল করা যেত। তাই আমরা সাইক্লোন-১, সাইক্লোন-২ লিখে এফডিসিতে দিয়ে আসলাম। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ জানতে পারলে তারা তা ধংস করে দিত। তাই কৌশলের আশ্রয় নিলাম। নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। আমি এফডিসিতে চাকরি করেছি, কাজ শিখেছি। আমার বন্ধুও ছিল সেখানে। তাকে বললাম তাড়াতাড়ি ডেভেলপ করে দাও। ডেভেলপ করে দিল। আমি পরের দিন নিয়ে এসে উনাকে দিলাম। তিনি তার লকারের মধ্যে সংরক্ষণ করলেন।

সংরক্ষণের ইতিহাস

২৫ মার্চ রাতে শুরু হলো জ্বালাও পোড়াও। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। আমাদের তারা চেনে। কে এই ভাষণ রেকর্ড করেছে এটাও পাকবাহিনী জানে। এর মধ্যেই পাক আর্মিরা শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে। তবে মুক্তিবাহিনীও বসে ছিল না। ধানমন্ডির পাওয়ার হাউস জ্বালিয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী। এই সময় আমাদের বিভাগের প্রধান মহিবুর রহমান ভাষণ সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। যেকোনো সময় পাকবাহিনী ভাষণটি ধংস করে দিতে পারে। এজন্য মহিবুর রহমান স্যার আমাকে ডেকে বললেন, তোমাকে একটা দায়িত্ব দেব। তিনি বললেন, তোমাকে এই মুহূর্তে ফিল্মগুলো নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে হবে। কোথায় যেতে হবে সেটাও বলে দিলেন তিনি। পরে টাকা দিয়ে আমাকে একটা ট্রাঙ্ক কিনে আনতে বললেন। সদরঘাট থেকে ট্রাঙ্ক কিনে আনলাম। সেই ট্রাঙ্কে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের ওপর করা ডকুমেন্টারি ও বঙ্গবন্ধুর কিছু ছবি দেন। ধরা পড়লে যেন নজরুল ইসলামের ডকুমেন্টারি মনে করেন। বিদায়ের ঘণ্টা আমার জীবন সংশয় বুঝতে পেরে স্যারকে বললাম, আমি আমার বাবার সঙ্গে দেখা করার পর চলে যাব। অনুমতি নিয়ে বাবার কাছে যাই। বাবা বিজি প্রেসে চাকরি করতেন। বাবাকে বললাম, অফিসের কাজে দুই দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। চিন্তা করবেন না। আমি আমার পরিবারের সঙ্গেও দেখা করিনি। পরিবারকে কিছুই বলি নাই। পরে স্যার আমাতে বিদায় জানানোর সময় চোখ বড় বড় করলেন। আমি এ সময় একটু ভীত হলাম।

এবার গন্তব্যে রওনার পালা

এবার নির্দেশনা মতো সচিবালয় থেকে সেই ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হতে হবে। কিন্তু বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা পাহারা দিচ্ছেন। পরে সচিবালয়ের দ্বিতীয় গেটের দায়িত্বে ছিলেন বাঙালি পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদ। তিনিও এই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার সহযোগিতায় বেবি ট্যাক্সিতে করে সচিবালয় থেকে বের হয়ে গন্তব্যে রওনা দেই। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল দুপুর ২টা থেকে ৩টার মধ্যে সচিবালয় থেকে ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশ দিয়ে চাঁনখারপুলে যাই। পরে চকবাজার হয়ে সোয়ারিঘাটে পৌঁছে নৌকায় করে জিনজিরায় যাই। সেখানে একটি বাসের ছাদে ট্রাঙ্ক নিয়ে ওঠে চলে যাই নবাবগঞ্জের বক্সনগরে। এরপর ঘোড়ার পিঠে ট্রাঙ্ক তুলে দিয়ে হেঁটে জয়পাড়ায় মজিদ দারোগার বাড়িতে যাই। সেখানেই প্রাথমিক সংরক্ষণ করা হয় এই ভাষণ। সেই বাড়িতে পৌঁছার পর মহিবুর রহমানকেও দেখতে পাই। তিনি বলেন, আমাকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর তিনি থাকতে পারেননি। আমার পেছনে পেছনে চলে এসেছেন। এরপর সেখান থেকে ট্রাঙ্কটি সরিয়ে চরকুসাই গ্রামের হাজি দানেশ ও উমেদ খাঁর ধানের গোলার ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয় ট্রাঙ্ক। পরে ট্রাঙ্কটি ভারতে নিয়ে যান মহিবুর রহমান স্যার। বিজয়ের পরে সেই ভাষণের ভিডিও ফুটেজ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

আমজাদ আলী খন্দকারের কর্মজীবন   

আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, প্রায় ১০-১২ বছর আগে স্ত্রী মারা যান। এরপরই আমার বাম হাত ও পা নিথর হয়ে যায়। বর্তমানে ভালো আছি। শুধু আমার চলাফেরায় একটু সমস্যা হয়। আমি আমার এক প্রতিবন্ধী ছেলেসহ চার ছেলে নিয়ে সুখেই বসবাস করছি।

প্রাপ্তি ও সুচিকিৎসা

আমি আমার প্রাপ্তি নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আমি যেখানে চাকরি করেছি সেখান থেকে অনেক কিছুই করতে পারতাম। কিন্তু সৎভাবে চাকরি জীবন পার করেছি। আমি বিভিন্ন মাধ্যম ধরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা করেছি। তিনি আমাকে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। কিন্তু তেমন কথা বলার সুযোগ হয়নি। চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। এখন উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ নেই। যখন সুযোগ ছিল তখনই কেউ খোঁজ নেয়নি। আমি এখন আর কারও কাছে কিছু চাইব না। যদি কেউ সহৃদয় হয় তাহলে আমি গ্রহণ করব। আমি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংরক্ষণের স্বীকৃতি পেয়েছি, এটাতেই অনেক খুশি। সাভারের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হামিদ মোহাম্মদ রঞ্জু বলেন, আমজাদ আলী খন্দকারের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া উচিৎ। আমি তাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জোর দাবি জানাই।

সংবাদটি শেয়ার করুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও সংবাদ :